কিডনি সুস্থ রাখুন: পানি, লবণ এবং প্রয়োজনীয় খাবারের গাইড

কিডনি সুস্থ রাখুন পানি লবণ এবং প্রয়োজনীয় খাবারের গাইড 1

কিডনি হলো আমাদের শরীরের ‘নীরব ফিল্টার’ বা ছাঁকনি। এটি প্রতি মুহূর্তে রক্ত পরিষ্কার করে বর্জ্য পদার্থ (যেমন ইউরিয়া) এবং অতিরিক্ত তরল প্রস্রাবের মাধ্যমে বের করে দেয়। এর পাশাপাশি কিডনি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ, লবণের ভারসাম্য রক্ষা এবং লোহিত রক্তকণিকা তৈরিতেও সাহায্য করে।

আমাদের কিডনির স্বাস্থ্যের প্রতি বিশেষ নজর দেওয়া জরুরি, কারণ এই বয়সেই উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিসের মতো রোগগুলো দেখা দিতে শুরু করে, যা কিডনি নষ্ট হওয়ার প্রধান দুটি কারণ।

কিডনির সমস্যা প্রথম দিকে ধরা পড়ে না, যখন ধরা পড়ে তখন অনেক দেরি হয়ে যায়। তাই আগে থেকেই কিডনি-বান্ধব খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

কিডনি সুস্থ রাখার তিনটি মূলনীতি:

১. পানি পান (সঠিক হাইড্রেশন): কিডনির প্রধান কাজই হলো পানির সাহায্যে শরীরকে পরিষ্কার করা।

  • কেন প্রয়োজন: পর্যাপ্ত পানি পান করলে কিডনি সহজেই রক্ত থেকে বর্জ্য ও অতিরিক্ত সোডিয়াম (লবণ) ছেঁকে বের করে দিতে পারে। পানি কম খেলে এই বর্জ্যগুলো কিডনিতে জমাট বেঁধে ‘কিডনি স্টোন’ বা পাথর তৈরি করতে পারে। পর্যাপ্ত পানি প্রস্রাবকে পাতলা রাখে এবং মূত্রনালীর সংক্রমণ (UTI) থেকেও রক্ষা করে, যা কিডনিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
  • কতটা পান করবেন: দিনে অন্তত ৮-১০ গ্লাস (২-৩ লিটার) পানি পান করা উচিত। তবে যাদের ইতোমধ্যে কিডনি রোগ আছে, তাদের ক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী পানির পরিমাণ সীমিত করতে হতে পারে।

২. লবণ কমানো (সোডিয়াম নিয়ন্ত্রণ): লবণ বা সোডিয়াম হলো কিডনির স্বাস্থ্যের জন্য সবচেয়ে বড় শত্রু।

  • কেন প্রয়োজন: অতিরিক্ত লবণ খেলে তা শরীর থেকে বের করার জন্য কিডনিকে অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে হয়। এই লবণ শরীরে পানি ধরে রাখে, যার ফলে রক্তের পরিমাণ বাড়ে এবং রক্তচাপ বৃদ্ধি পায়। উচ্চ রক্তচাপ কিডনির ভেতরের সূক্ষ্ম রক্তনালীগুলোকে (ফিল্টার) ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং ধীরে ধীরে কিডনির কার্যক্ষমতা নষ্ট করে দেয়।
  • কীভাবে কমাবেন:
    • কাঁচা লবণ বর্জন: খাবারের পাতে আলাদা লবণ নেওয়া আজই বন্ধ করুন।
    • প্রক্রিয়াজাত খাবার বাদ দিন: চিপস, চানাচুর, সস, কেচাপ, আচার, প্যাকেটজাত স্যুপ, নুডুলস এবং ফাস্ট ফুডে প্রচুর ‘লুকানো’ লবণ থাকে। এগুলো এড়িয়ে চলুন।
    • রান্নায় কম লবণ: রান্নার সময় কম লবণ দিন। স্বাদের জন্য লেবুর রস, ভিনেগার, আদা, রসুন, ধনে পাতা ও অন্যান্য মশলা ব্যবহার করুন।

৩. কিডনি-বান্ধব খাবার বাছাই: কিছু খাবার আছে যা কিডনির ওপর চাপ কমায় এবং এর স্বাস্থ্য ভালো রাখে।

  • বেরি জাতীয় ফল (জাম, স্ট্রবেরি): এগুলোতে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে যা কিডনির কোষগুলোকে ক্ষয়ের হাত থেকে রক্ষা করে এবং প্রদাহ কমায়।
  • ফুলকপি ও বাঁধাকপি: এগুলোতে ফাইবার ও ভিটামিন সি আছে, এবং পটাশিয়ামের মাত্রাও কম (যা কিডনি রোগীদের জন্য ভালো)।
  • আপেল: এতে ‘পেকটিন’ নামক ফাইবার থাকে যা রক্তে কোলেস্টেরল ও সুগার নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে, যা পরোক্ষভাবে কিডনিকে ভালো রাখে।
  • রসুন: এটি লবণের একটি দুর্দান্ত বিকল্প এবং এতে অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি গুণ রয়েছে।
  • মাছ: চর্বিযুক্ত মাছে থাকা ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড কিডনির প্রদাহ কমায়।

৪. বাড়তি সতর্কতা (বিশেষ করে চল্লিশের পর):

  • রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ: আপনার যদি উচ্চ রক্তচাপ বা ডায়াবেটিস থাকে, তবে তা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখুন। এই দুটি রোগই কিডনি নষ্ট করে।
  • ব্যথানাশক ওষুধ: চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ঘন ঘন ব্যথানাশক ওষুধ (Painkillers) খাবেন না। এগুলো কিডনির মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে।
  • প্রোটিন: প্রোটিন জরুরি, তবে অতিরিক্ত প্রাণিজ প্রোটিন (বিশেষ করে রেড মিট) কিডনির ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে।

কিডনি সুস্থ রাখা কোনো কঠিন কাজ নয়। এটি একটি সচেতন জীবনযাত্রার অংশ। প্রতিদিন পর্যাপ্ত পানি পান করা, খাবারে লবণের ব্যবহার কমানো এবং প্রক্রিয়াজাত খাবারের বদলে তাজা ফল ও সবজি খাওয়ার অভ্যাসই আপনার কিডনিকে দীর্ঘজীবী করতে পারে। আপনার শরীরের এই গুরুত্বপূর্ণ ফিল্টারটির যত্ন নিন, এটি আপনার খেয়াল রাখবে।

    Scroll to Top