আমরা প্রায়ই হার্ট, হাড় বা ডায়াবেটিস নিয়ে যতটা চিন্তিত থাকি, আমাদের অন্ত্র বা ‘গাট’ (Gut) নিয়ে ততটা ভাবি না। অথচ চিকিৎসা বিজ্ঞান অন্ত্রকে আমাদের ‘দ্বিতীয় মস্তিষ্ক’ (Second Brain) বলে অভিহিত করে। কারণ আমাদের হজম প্রক্রিয়া, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং এমনকি মানসিক স্বাস্থ্যের অনেকটাই এই অন্ত্রের ভেতরের পরিবেশের ওপর নির্ভরশীল। চল্লিশের পর হজমশক্তি স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা ধীর হয়ে আসে। এই সময়ে অ্যাসিডিটি, গ্যাস, কোষ্ঠকাঠিন্য বা আইবিএস (Irritable Bowel Syndrome)-এর মতো সমস্যা বাড়তে দেখা যায়। এর মূল কারণ হলো অন্ত্রে থাকা উপকারী ব্যাকটেরিয়ার ভারসাম্য নষ্ট হওয়া। এই ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে এবং হজম প্রক্রিয়াকে সচল রাখতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে ফাইবার (আঁশ) এবং প্রোবায়োটিক।
অন্ত্রের স্বাস্থ্য কেন এত গুরুত্বপূর্ণ? আমাদের অন্ত্রে লক্ষ লক্ষ কোটি ব্যাকটেরিয়া বাস করে, যাদেরকে ‘গাট মাইক্রোবায়োম’ বলা হয়। এর মধ্যে ভালো ব্যাকটেরিয়াও আছে, খারাপ ব্যাকটেরিয়াও আছে। যখন ভালো ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা বেশি থাকে, তখন:
- খাবার সঠিকভাবে হজম হয় এবং পুষ্টি শোষিত হয়।
 - রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী থাকে।
 - শরীরের প্রদাহ (Inflammation) কমে।
 - মানসিক চাপ ও উদ্বেগ কম থাকে (কারণ অন্ত্র সেরোটোনিন বা ‘হ্যাপি হরমোন’ তৈরিতে সাহায্য করে)।
 
চল্লিশের পর এই ভালো ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা কমতে শুরু করতে পারে, যার ফলে হজমের সমস্যা দেখা দেয়।
অন্ত্রের স্বাস্থ্যের স্তম্ভ
১: ফাইবার (আঁশ)
ফাইবার বা আঁশ হলো উদ্ভিজ্জ খাবারের সেই অংশ যা আমাদের শরীর হজম করতে পারে না। কিন্তু এটি অন্ত্রের জন্য অপরিহার্য।
- কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে: ফাইবার পানি শোষণ করে মলকে নরম করে এবং অন্ত্রের মধ্য দিয়ে এর চলাচল সহজ করে। এটি অন্ত্রকে পরিষ্কার রাখার জন্য ঝাড়ুর মতো কাজ করে।
 - প্রি-বায়োটিক হিসেবে কাজ করে: ফাইবার নিজে হজম না হলেও এটি অন্ত্রের ভালো ব্যাকটেরিয়াগুলোর প্রধান খাদ্য। অর্থাৎ, ফাইবার খেলে ভালো ব্যাকটেরিয়ারা সবল হয় এবং বংশবৃদ্ধি করে।
 
২: প্রোবায়োটিক (উপকারী ব্যাকটেরিয়া)
প্রোবায়োটিক হলো জীবন্ত উপকারী ব্যাকটেরিয়া যা সরাসরি আমাদের অন্ত্রে ভালো ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা বাড়ায়।
- ভারসাম্য ফিরিয়ে আনে: অ্যান্টিবায়োটিক সেবন, মানসিক চাপ বা অস্বাস্থ্যকর খাবারের কারণে অন্ত্রের ভালো ব্যাকটেরিয়া মরে গেলে প্রোবায়োটিক সেই ঘাটতি পূরণ করে।
 - হজমশক্তি বাড়ায়: এটি ল্যাকটোজ (দুধের শর্করা) হজমে সাহায্য করে এবং গ্যাস-অম্বলের সমস্যা কমায়।
 - ইমিউনিটি বুস্ট করে: অন্ত্র সুস্থ থাকলে তা ক্ষতিকর জীবাণুর বিরুদ্ধে সুরক্ষা বলয় তৈরি করে।
 
কী ধরনের ফাইবার খাবেন?
- দ্রবণীয় ফাইবার (Soluble Fiber): এটি পানিতে গলে গিয়ে জেলির মতো হয়। এটি ব্লাড সুগার ও কোলেস্টেরল কমায়।
উৎস: ওটস, বার্লি, আপেল, পেয়ারা, গাজর, সিমের বিচি, এইসব গুলোর ভুসি। - অদ্রবণীয় ফাইবার (Insoluble Fiber): এটি মলের পরিমাণ বাড়িয়ে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে।
উৎস: লাল আটা, লাল চাল, বাদাম, ফুলকপি, ব্রকলি এবং বিভিন্ন ধরনের শাক (বিশেষ করে আঁশযুক্ত শাক যেমন পুঁই, ডাঁটা)। 
প্রোবায়োটিকের সেরা উৎস:
- টক দই: প্রোবায়োটিকের সবচেয়ে সহজলভ্য এবং সেরা উৎস হলো ঘরে পাতা বা ‘লাইভ কালচার’ (Live Culture) টক দই। মিষ্টি দইয়ের চেয়ে টক দই এক্ষেত্রে বেশি উপকারী।
 - ফার্মেন্টেড বা গাঁজানো খাবার: ভিনেগার বা লবণ-পানিতে সংরক্ষিত খাবার (যেমন- জলপাই, শসার আচার), পনির এবং কিছু কিছু গবেষণায় বাঙালির পান্তা ভাতেও উপকারী ব্যাকটেরিয়ার সন্ধান পাওয়া গেছে।
 
অন্ত্র ভালো রাখতে আরও কিছু জরুরি টিপস:
১. পর্যাপ্ত পানি পান করুন: ফাইবার ঠিকমতো কাজ করার জন্য প্রচুর পানি প্রয়োজন। দিনে অন্তত ৮-১০ গ্লাস পানি পান করুন।
২. ধীরে চিবিয়ে খান: খাবার যত বেশি চিবিয়ে খাবেন, হজম তত সহজ হবে।
৩. প্রক্রিয়াজাত খাবার কমান: অতিরিক্ত চিনি, ফাস্ট ফুড এবং প্রক্রিয়াজাত খাবার অন্ত্রের খারাপ ব্যাকটেরিয়াকে উৎসাহিত করে।
৪. মানসিক চাপ কমান: মানসিক চাপ সরাসরি অন্ত্রের স্বাস্থ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। তাই মেডিটেশন বা হালকা ব্যায়াম করুন।
চল্লিশের পর একটি সুস্থ অন্ত্র আপনার সামগ্রিক সুস্থতার চাবিকাঠি। প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় পর্যাপ্ত ফাইবার সমৃদ্ধ শাকসবজি, ফলমূল, লাল আটা এবং এক বাটি টক দই যোগ করার মতো সহজ অভ্যাসই আপনার হজম প্রক্রিয়াকে সচল রাখতে এবং আপনাকে ভেতর থেকে শক্তিশালী করে তুলতে পারে।




