খাদ্যজনিত ব্যাধি বা Eating Disorder শুধু খাবার নিয়ে নয়, এটি এক ধরনের জটিল মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা যা মানুষের খাওয়া, শরীরের ওজন ও নিজের চেহারা নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তা সৃষ্টি করে। প্রতিটি ব্যাধির আলাদা লক্ষণ থাকলেও, এগুলোর মূল বিষয় হলো খাদ্য, শরীর ও নিয়ন্ত্রণের ওপর অস্বাভাবিক মনোযোগ। এসব অবস্থায় চিকিৎসক ও মনোবিদদের সহায়তা অত্যন্ত জরুরি।
নিচে ছয়টি সাধারণ খাদ্যজনিত ব্যাধি ও তাদের লক্ষণ তুলে ধরা হলো:
১. অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসা (Anorexia Nervosa)
এই ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তিরা খুব সীমিত পরিমাণে ক্যালোরি গ্রহণ করেন এবং ওজন বেড়ে যাওয়ার প্রবল ভয় অনুভব করেন। অনেক সময় শরীর স্বাভাবিক ওজনেই থাকলেও তারা নিজেকে মোটা মনে করেন। অ্যানোরেক্সিয়ার দুটি ধরন রয়েছে। ১. Restricting type (খাবার এড়িয়ে চলা, উপবাস বা অতিরিক্ত ব্যায়াম) এবং ২. Binge-eating/purging type (খাওয়ার পর বমি করা বা ল্যাক্সেটিভ ব্যবহার করা)। দীর্ঘমেয়াদে এটি চুল, নখ ও হাড় দুর্বল করে, বন্ধ্যাত্বের ঝুঁকি বাড়ায় এবং গুরুতর ক্ষেত্রে হৃদযন্ত্র বা অন্যান্য অঙ্গের ক্ষতি করে মৃত্যুও ঘটাতে পারে।
২. বুলিমিয়া নার্ভোসা (Bulimia Nervosa)
এই ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তিরা অল্প সময়ে প্রচুর খাবার খেয়ে ফেলেন (বিঞ্জ ইটিং) এবং পরে বমি করা, উপবাস থাকা বা অতিরিক্ত ব্যায়ামের মাধ্যমে ক্যালোরি ক্ষতিপূরণ করতে চেষ্টা করেন। এর ফলে গলা ব্যথা, দাঁতের ক্ষয়, অ্যাসিড রিফ্লাক্স, ডিহাইড্রেশন ও ইলেকট্রোলাইটের ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে, যা স্ট্রোক বা হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি তৈরি করে।
৩. বিঞ্জ ইটিং ডিজঅর্ডার (Binge Eating Disorder)
এই ব্যাধিতে আক্রান্তরা অনেক সময় ক্ষুধা না থাকা সত্ত্বেও দ্রুত ও গোপনে প্রচুর খাবার খেয়ে ফেলেন, এমনকি অস্বস্তিকরভাবে পেট ভরে যাওয়া পর্যন্ত। পরে অপরাধবোধ, লজ্জা বা আত্মঘৃণার অনুভূতি দেখা দেয়। বুলিমিয়ার মতোই এখানে অতিরিক্ত খাবার খাওয়া হয়, তবে পরবর্তীতে বমি করা বা ক্যালোরি ক্ষতিপূরণের কোনো প্রচেষ্টা থাকে না। এর ফলে স্থূলতা, হৃদরোগ, ও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
৪. পিকা (Pica)
পিকা হলো এমন একটি ব্যাধি যেখানে ব্যক্তি খাদ্য নয় এমন বস্তু যেমন মাটি, বরফ, সাবান, চক, কাগজ বা চুল খেয়ে থাকেন। এটি সাধারণত বুদ্ধিবিকাশে সমস্যা আছে এমন ব্যক্তি, অটিজম বা মানসিক অসুস্থতায় আক্রান্তদের মধ্যে দেখা যায়। এতে বিষক্রিয়া, সংক্রমণ, পেটের ক্ষত এবং মৃত্যুও ঘটতে পারে।
৫. রুমিনেশন ডিজঅর্ডার (Rumination Disorder)
এই অবস্থায় মানুষ খাবার খাওয়ার পর তা মুখে ফিরিয়ে এনে আবার চিবিয়ে খায় বা ফেলে দেয়। এটি সাধারণত খাবার খাওয়ার ৩০ মিনিটের মধ্যে ঘটে। শিশুদের ক্ষেত্রে এটি ৩ থেকে ১২ মাস বয়সে দেখা দিতে পারে এবং অনেক সময় নিজে থেকেই সেরে যায়। কিন্তু যদি না সারে, তাহলে এটি ওজন কমে যাওয়া ও অপুষ্টির কারণে মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে। প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে থেরাপি কার্যকর ভূমিকা রাখে।
৬. এআরএফআইডি (Avoidant/Restrictive Food Intake Disorder – ARFID)
এই ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তিরা খাবারের গন্ধ, রং, টেক্সচার বা স্বাদের প্রতি তীব্র অরুচি অনুভব করেন। ফলে তারা প্রয়োজনীয় ক্যালোরি বা পুষ্টি গ্রহণ করতে পারেন না। এতে ওজন কমে যাওয়া, বৃদ্ধি ব্যাহত হওয়া, ও পুষ্টিহীনতার সমস্যা দেখা দেয়। এটি সাধারণ খুঁতখুঁতে খাওয়ার অভ্যাস নয়, বরং সামাজিক জীবন ও শারীরিক স্বাস্থ্যের ওপর বড় প্রভাব ফেলে।
অন্যান্য খাদ্যজনিত ব্যাধি
উপরের ছয়টির বাইরে আরও কিছু ব্যাধি আছে যেমন Purging Disorder (বিঞ্জ ইটিং ছাড়াই বমি বা ল্যাক্সেটিভ ব্যবহার), Night Eating Syndrome (রাতে অতিরিক্ত খাওয়ার অভ্যাস) এবং OSFED (Other Specified Feeding or Eating Disorders)। এছাড়া Orthorexia নামের একটি প্রবণতা এখন ক্রমেই আলোচিত হচ্ছে যেখানে মানুষ অতিরিক্তভাবে “স্বাস্থ্যকর খাওয়া” নিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। এতে তারা পুরো খাদ্যগোষ্ঠী বাদ দিতে পারেন, যা অপুষ্টি ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতার দিকে নিয়ে যায়।
যদি এই লক্ষণগুলোর মধ্যে কোনোটি নিজের মধ্যে লক্ষ্য করেন, তাহলে দেরি না করে চিকিৎসক বা মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। খাদ্যজনিত ব্যাধি ভয়ঙ্কর হলেও চিকিৎসা ও সহায়তার মাধ্যমে সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়া সম্ভব। পেশাদার চিকিৎসা, সহায়ক সম্প্রদায় ও পরিবার পাশে থাকলে পুনরুদ্ধারের পথ অনেক সহজ হয়।





