উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশনকে প্রায়শই ‘নীরব ঘাতক’ (Silent Killer) বলা হয়। কারণ এর তেমন কোনো স্পষ্ট লক্ষণ দেখা যায় না, কিন্তু এটি নীরবে হৃদপিণ্ড, মস্তিষ্ক, কিডনি এবং চোখের মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে। বিশেষ করে চল্লিশের পর ধমনীর স্থিতিস্থাপকতা কমতে থাকায় এবং জীবনযাত্রার নানা ভুলের কারণে উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বাড়ে।
সুখবর হলো, ওষুধ ছাড়াই কেবল খাদ্যাভ্যাসের কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের মাধ্যমে রক্তচাপ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। এর মধ্যে সবচেয়ে জরুরি দুটি উপায় হলো: লবণ (সোডিয়াম) কমানো এবং পটাশিয়াম ও ম্যাগনেশিয়াম সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ বাড়ানো।
রক্তচাপের ওপর সোডিয়াম (লবণ) ও পটাশিয়ামের প্রভাব:
সোডিয়াম এবং পটাশিয়াম দুটি খনিজ যা শরীরে তরলের ভারসাম্য রক্ষা করে।
- সোডিয়াম (লবণ): শরীরে সোডিয়ামের পরিমাণ বাড়লে শরীর তা ভারসাম্য করতে পানি ধরে রাখে। এই অতিরিক্ত পানি রক্তের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়, যা রক্তনালীর ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে এবং রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয়।
- পটাশিয়াম: পটাশিয়াম ঠিক এর উল্টো কাজ করে। এটি শরীর থেকে অতিরিক্ত সোডিয়াম প্রস্রাবের মাধ্যমে বের করে দিতে সাহায্য করে এবং রক্তনালীর দেয়ালকে শিথিল (Relax) রাখে, ফলে রক্তচাপ কমে।
ধাপ ১: লবণ (সোডিয়াম) কমানোর কার্যকরী উপায়:
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, একজন সুস্থ মানুষের দিনে ৫ গ্রামের (প্রায় ১ চা চামচ) বেশি লবণ খাওয়া উচিত নয়। উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের তা আরও কমানো প্রয়োজন।
- কাঁচা লবণ বর্জন: খাবারের পাতে আলাদা লবণ নেওয়া আজই বন্ধ করুন।
- লুকানো লবণ চিনুন: আমরা যা লবণ খাই তার বেশিরভাগই আসে প্রক্রিয়াজাত খাবার থেকে। চিপস, চানাচুর, সস, কেচাপ, আচার, প্যাকেটজাত স্যুপ এবং ফাস্ট ফুডে প্রচুর লবণ থাকে। এগুলো এড়িয়ে চলুন।
- রান্নার সময় কম লবণ: রান্নায় লবণের পরিমাণ ধীরে ধীরে কমান। স্বাদের জন্য লবণের বদলে লেবুর রস, ভিনেগার, ধনে পাতা, পুদিনা পাতা, আদা, রসুন এবং বিভিন্ন মশলা ব্যবহার করুন।
- বাইরের খাবার: রেস্তোরাঁর খাবারে প্রায়ই লবণ বেশি থাকে। সম্ভব হলে ঘরে তৈরি খাবার খান।
ধাপ ২: পটাশিয়াম ও ম্যাগনেশিয়াম সমৃদ্ধ খাবার বাড়ান:
পটাশিয়াম সমৃদ্ধ খাবার (রক্তচাপের বন্ধু):
- কলা: পটাশিয়ামের সবচেয়ে সহজলভ্য উৎস। প্রতিদিন একটি কলা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করতে পারে।
- সবুজ শাক: পালং শাক, পুঁই শাক, কচু শাক এবং অন্যান্য গাঢ় সবুজ শাকে প্রচুর পটাশিয়াম থাকে।
- বিট: বিট বা বিটরুট নাইট্রিক অক্সাইড তৈরিতে সাহায্য করে, যা রক্তনালীকে প্রসারিত করে এবং রক্তচাপ কমায়।
- ডাবের পানি: এটি পটাশিয়াম ও অন্যান্য মিনারেলের প্রাকৃতিক উৎস।
- অন্যান্য: মিষ্টি আলু, টমেটো, সিমের বিচি, আলু বোখারা এবং টক দই পটাশিয়ামের ভালো উৎস।
ম্যাগনেশিয়াম সমৃদ্ধ খাবার (রক্তনালীকে শিথিল রাখে):
ম্যাগনেশিয়াম রক্তনালীকে রিল্যাক্স করতে সাহায্য করে।
- বাদাম ও বীজ: কাঠবাদাম, কাজুবাদাম এবং কুমড়োর বীজ ম্যাগনেশিয়ামের চমৎকার উৎস।
- ডাল ও শস্য: বিভিন্ন ধরনের ডাল, ছোলা এবং লাল চাল বা আটায় ম্যাগনেশিয়াম পাওয়া যায়।
- ডার্ক চকোলেট: অল্প পরিমাণ ডার্ক চকোলেটও (যাতে ৭০% কোকো আছে) উপকারী হতে পারে।
জীবনযাত্রার অন্যান্য পরিবর্তন:
- ওজন নিয়ন্ত্রণ: পেটের মেদ বাড়লে রক্তচাপ বাড়ে। ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
- ব্যায়াম: প্রতিদিন ৩০ মিনিট হাঁটা রক্তচাপ কমাতে ম্যাজিকের মতো কাজ করে।
- মানসিক চাপ: যোগব্যায়াম (Yoga) বা মেডিটেশনের মাধ্যমে মানসিক চাপ কমান, কারণ চাপ বাড়লে রক্তচাপ বাড়ে।
উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া। আপনার রান্নাঘরের ছোট ছোট পরিবর্তন, যেমন লবণের বয়াম সরিয়ে রাখা এবং প্লেটে বেশি করে সবুজ শাক ও কলা যোগ করা, আপনার হৃদপিণ্ডের ওপর থেকে অনেক বড় চাপ সরিয়ে নিতে পারে। আজ থেকেই এই স্বাস্থ্যকর অভ্যাসগুলো শুরু করুন এবং আপনার রক্তচাপকে নিয়ন্ত্রণে রাখুন।





