চল্লিশ বছর বয়সের পর যে স্বাস্থ্য ঝুঁকিগুলো সবচেয়ে বেশি দেখা দেয়, তার মধ্যে অন্যতম হলো টাইপ-২ ডায়াবেটিস। এই বয়সে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স (শরীরের ইনসুলিন ঠিকমতো কাজ না করা), বেঠিক খাদ্যাভ্যাস, শারীরিক পরিশ্রমের অভাব এবং বংশগত কারণে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যায়। ডায়াবেটিস একবার হলে তা পুরোপুরি সারিয়ে তোলা কঠিন, কিন্তু সঠিক খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাত্রার মাধ্যমে একে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের মূলমন্ত্র হলো রক্তের শর্করা বা ব্লাড সুগারকে স্থিতিশীল রাখা।
কেন চল্লিশের পর ঝুঁকি বাড়ে? বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমাদের প্যানক্রিয়াস বা অগ্ন্যাশয়ের ইনসুলিন তৈরির ক্ষমতা কিছুটা কমে আসতে পারে। তার চেয়েও বড় বিষয় হলো, শরীরে জমে থাকা অতিরিক্ত মেদ, বিশেষ করে পেটের মেদ, কোষগুলোকে ইনসুলিনের প্রতি কম সংবেদনশীল করে তোলে। একেই ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স বলে। ফলে রক্তে চিনি জমতে থাকে এবং ডায়াবেটিস দেখা দেয়।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে খাদ্যাভ্যাসের মূলনীতি:
ডায়াবেটিস রোগীদের খাবার নিয়ে সবচেয়ে বেশি দ্বিধা থাকে। মূল লক্ষ্য হলো এমন খাবার খাওয়া যা রক্তে শর্করা হঠাৎ করে বাড়িয়ে দেয় না।
১. শর্করা বা কার্বোহাইড্রেট চিনুন: শর্করা বাদ দেওয়া নয়, বরং ‘ভালো’ শর্করা বেছে নেওয়া জরুরি।
- ভালো শর্করা (জটিল শর্করা): এই খাবারগুলো ধীরে ধীরে হজম হয় এবং রক্তে চিনি আস্তে আস্তে ছাড়ে। যেমন: লাল চাল, লাল আটা, ওটস, বার্লি, ডাল এবং সবজি।
- খারাপ শর্করা (সরল শর্করা): এগুলো খুব দ্রুত রক্তে মিশে সুগার স্পাইক ঘটায়। যেমন: সাদা চাল, সাদা আটা (ময়দা), চিনি, মধু, কোমল পানীয়, ফলের রস এবং মিষ্টিজাতীয় খাবার।
২. ফাইবারকে বন্ধু বানান: আঁশ বা ফাইবার হলো ডায়াবেটিস রোগীর জন্য আশীর্বাদ। এটি শর্করা শোষণের গতি কমিয়ে দেয়, ফলে ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণে থাকে।
- কী খাবেন: প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় রাখুন প্রচুর সবুজ শাক (পালং, পুঁই, লাউ শাক, কলমি শাক), সবজি (ঢেঁড়স, লাউ, চালকুমড়া, ব্রকলি, ফুলকপি), শসা, টমেটো এবং খোসা সহ ফল (পেয়ারা, আপেল, নাশপাতি)।
৩. প্রোটিনের সঠিক উৎস বাছুন: প্রোটিন পেট ভরা রাখে এবং সুগার নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
- কী খাবেন: চর্বি ছাড়া মাংস (মুরগির বুকের মাংস), মাছ (বিশেষ করে সামুদ্রিক মাছ), ডিম (কুসুম সহ একটি), টক দই, পনির বা ছানা এবং বিভিন্ন প্রকার ডাল।
৪. স্বাস্থ্যকর ফ্যাটের গুরুত্ব: ভালো ফ্যাট ইনসুলিন সেনসিটিভিটি বাড়াতে সাহায্য করে।
- কী খাবেন: বাদাম (কাঠবাদাম, আখরোট), অলিভ অয়েল, অ্যাভোকাডো, সূর্যমুখীর বীজ এবং মাছের তেল।
খাদ্যাভ্যাসের ৫টি জরুরি নিয়ম:
১. একবারে বেশি না খাওয়া: সারাদিনের খাবারকে ৫-৬টি ছোট ভাগে ভাগ করে নিন। ৩টি প্রধান খাবার এবং ২টি হালকা নাস্তা। এতে ব্লাড সুগার স্থিতিশীল থাকে।
২. প্লেট মেথড অনুসরণ: আপনার প্লেটের অর্ধেক অংশ শাকসবজি ও সালাদ দিয়ে পূরণ করুন, এক চতুর্থাংশ প্রোটিন (মাছ/মাংস/ডাল) এবং বাকি এক চতুর্থাংশ জটিল শর্করা (লাল চাল/আটা) রাখুন।
৩. পানি পান: দিনে অন্তত ৮-১০ গ্লাস পানি পান করুন। এটি শরীর থেকে টক্সিন বের করতে এবং সুগার নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। ফলের রসের বদলে আস্ত ফল খান।
৪. খাবারের সময়: প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে খাবার খাওয়ার অভ্যাস করুন। সকালের নাস্তা কোনোভাবেই বাদ দেওয়া যাবে না।
৫. ব্যায়াম: খাবার যেমন জরুরি, ব্যায়ামও তেমনই। প্রতিদিন অন্তত ৩০-৪০ মিনিট দ্রুত হাঁটা, সাঁতার বা হালকা ব্যায়াম রক্ত থেকে গ্লুকোজ কোষে প্রবেশ করতে সাহায্য করে।
চল্লিশের পর ডায়াবেটিস হওয়া মানেই জীবনের সব স্বাদে লাগাম টানা নয়। এটি কেবল একটি সংকেত যে আপনার শরীরকে এখন একটু বাড়তি যত্ন নিতে হবে। সঠিক জ্ঞান, শৃঙ্খলাবদ্ধ খাদ্যাভ্যাস এবং নিয়মিত ব্যায়ামের মাধ্যমে আপনি ডায়াবেটিসকে নিয়ন্ত্রণ করে একটি সম্পূর্ণ সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেন।





