আমাদের হৃদপিণ্ড বা হার্ট হলো শরীরের ইঞ্জিন। এই ইঞ্জিন সচল থাকলে আমরা সচল থাকি। কিন্তু চল্লিশ বছর বয়সের পর নানা কারণে এই ইঞ্জিনে সমস্যা দেখা দেওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। উচ্চ কোলেস্টেরল, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস এবং অস্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রার কারণে রক্তনালীতে চর্বি জমতে শুরু করে (অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিস), যা থেকে হৃদরোগ বা হার্ট অ্যাটাকের মতো মারাত্মক ঘটনা ঘটতে পারে। তবে আশার বিষয় হলো, হৃদরোগ অনেকাংশেই প্রতিরোধযোগ্য। প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় কিছু বিশেষ খাবার যোগ করার মাধ্যমে আপনি আপনার হার্টকে দীর্ঘকাল সুস্থ ও শক্তিশালী রাখতে পারেন।
হৃদরোগের ঝুঁকি কেন বাড়ে? চল্লিশের পর মেটাবলিজম ধীর হওয়ায় রক্তে ‘খারাপ’ কোলেস্টেরল (LDL) বাড়তে থাকে এবং ‘ভালো’ কোলেস্টেরল (HDL) কমতে থাকে। এর সাথে যোগ হয় মানসিক চাপ ও শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা। এই সবকিছু মিলেই হৃদরোগের পথ তৈরি করে।
হার্টকে সুস্থ রাখতে ৫টি সুপারফুড:
১. ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড (চর্বিযুক্ত মাছ):
- কেন খাবেন: ওমেগা-৩ হলো এক প্রকার স্বাস্থ্যকর ফ্যাট, যা হার্টের জন্য মহাঔষধ। এটি রক্তে ট্রাইগ্লিসারাইড (এক প্রকার ক্ষতিকর চর্বি) কমায়, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে, রক্তনালীর প্রদাহ কমায় এবং রক্ত জমাট বাঁধার প্রবণতা রোধ করে।
- কী খাবেন: সামুদ্রিক মাছ যেমন স্যামন, টুনা। আমাদের দেশি মাছেদের মধ্যে ইলিশ, রুই, পাঙ্গাস মাছেও ভালো পরিমাণে ওমেগা-৩ পাওয়া যায়। সপ্তাহে অন্তত দুই থেকে তিন দিন চর্বিযুক্ত মাছ খাওয়ার চেষ্টা করুন।
২. বাদাম ও বীজ (স্বাস্থ্যকর ফ্যাটের ভাণ্ডার):
- কেন খাবেন: বাদামে রয়েছে মনো-আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট, ফাইবার এবং ভিটামিন ই, যা রক্ত থেকে খারাপ কোলেস্টেরল (LDL) কমাতে সাহায্য করে।
- কী খাবেন: প্রতিদিন এক মুঠো (প্রায় ৩০ গ্রাম) বাদাম, বিশেষ করে কাঠবাদাম (Almonds) এবং আখরোট (Walnuts) হার্টের জন্য খুবই উপকারী। এর পাশাপাশি তিসির বীজ (Flax seeds) এবং চিয়া সিড (Chia seeds) ওমেগা-৩-এর চমৎকার উদ্ভিজ্জ উৎস।
৩. ওটস বা হোল গ্রেইন (ফাইবারের শক্তি):
- কেন খাবেন: ওটসে ‘বিটা-গ্লুকান’ নামক এক বিশেষ ধরনের দ্রবণীয় ফাইবার থাকে। এই ফাইবার শরীরে স্পঞ্জের মতো কাজ করে এবং কোলেস্টেরলকে শোষণ করে শরীর থেকে বের করে দেয়।
- কী খাবেন: সকালের নাস্তায় ওটস মিল্ক (দুধ বা পানি দিয়ে রান্না করা ওটস) একটি চমৎকার খাবার। এছাড়া লাল চাল, লাল আটা এবং বার্লিও (যব) হার্টের জন্য উপকারী।
৪. রঙিন ফল ও শাকসবজি (অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও পটাশিয়াম):
- কেন খাবেন: ফল ও সবজিতে থাকা ফাইবার কোলেস্টেরল কমায়। আর এগুলোতে থাকা পটাশিয়াম রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে (যা হার্টের ওপর চাপ কমায়)। বিভিন্ন রঙিন ফলমূলে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রক্তনালীর ক্ষয় রোধ করে।
- কী খাবেন: প্রতিদিন অন্তত ৫ ধরনের ফল ও সবজি খাওয়ার চেষ্টা করুন। যেমন:
- সবুজ: পালং শাক, ব্রকলি, লাউ (পটাশিয়াম ও ফাইবার)।
- লাল: টমেটো, বেদানা, আপেল (লাইকোপিন ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট)।
- কমলা/হলুদ: গাজর, কমলা (বিটা-ক্যারোটিন)।
- নীল/বেগুনি: জাম, বিট (অ্যান্থোসায়ানিন)।
৫. স্বাস্থ্যকর তেল (অলিভ অয়েল):
- কেন খাবেন: রান্নার তেল হার্টের স্বাস্থ্যে বড় ভূমিকা রাখে। স্যাচুরেটেড ফ্যাট (যেমন ঘি, মাখন, পাম তেল) বেশি খেলে কোলেস্টেরল বাড়ে। এর বদলে আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটযুক্ত তেল ব্যবহার করা উচিত।
- কী খাবেন: এক্সট্রা ভার্জিন অলিভ অয়েল হার্টের জন্য সেরা। এটি ভালো কোলেস্টেরল (HDL) বাড়ায়। সালাদে বা হালকা রান্নায় এটি ব্যবহার করা যায়। এছাড়া রাইস ব্র্যান অয়েল বা সরিষার তেলও পরিমিত পরিমাণে ব্যবহার করা যেতে পারে।
যা অবশ্যই এড়িয়ে চলবেন:
- ট্রান্স ফ্যাট: বেকারি পণ্য, ফাস্ট ফুড, ডালডা, মার্জারিন। এগুলো সরাসরি রক্তনালী ব্লক করে।
- অতিরিক্ত চিনি: কোমল পানীয়, মিষ্টি, প্যাকেটজাত জুস। এগুলো ওজন বাড়ায় এবং প্রদাহ সৃষ্টি করে।
- প্রক্রিয়াজাত মাংস: সসেজ, বেকন ইত্যাদি।
আপনার হার্ট আপনার কাছে প্রতিদিন স্বাস্থ্যকর খাবার আশা করে। এটি কোনো রকেট সায়েন্স নয়; কেবল কিছু ক্ষতিকর খাবার বাদ দিয়ে তার জায়গায় মাছ, বাদাম, ওটস এবং তাজা শাকসবজি যোগ করা। চল্লিশের পর হার্টের যত্ন নিন, আপনার হার্টও সারাজীবন আপনার খেয়াল রাখবে।





