বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীরের অনেক অঙ্গের মতো ফুসফুসও ধীরে ধীরে তার কর্মক্ষমতা হারাতে শুরু করে। American Lung Association এর গবেষণা বলছে, ৪০ বছর বয়সের পর থেকে প্রতি বছর ফুসফুসের কার্যক্ষমতা প্রায় ১% হারে কমে যেতে পারে। এর ফলে শরীরে অক্সিজেন প্রবাহ কমে যায়, ক্লান্তি বেড়ে যায়, এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের কষ্ট বা শ্বাসকষ্টের ঝুঁকি বাড়ে। তবে সুখবর হলো, নিয়মিত যোগব্যায়াম করলে এই ক্ষয় রোধ করা সম্ভব। বিশেষ করে শ্বাসপ্রশ্বাসের ব্যায়াম বা প্রণায়াম এবং বুক খোলার আসনগুলো ফুসফুসকে শক্তিশালী করে, শ্বাস নেওয়ার ক্ষমতা বাড়ায় এবং শ্বাসের ছন্দকে স্বাভাবিক রাখে।
বয়সের সাথে কেন ফুসফুসের কর্মক্ষমতা কমে যায়
বয়স বাড়লে ফুসফুসের ইলাস্টিসিটি কমে যায়, বুকের হাড় শক্ত হয়ে যায় এবং ডায়াফ্রাম বা প্রধান শ্বাসপ্রশ্বাসের পেশী দুর্বল হয়। দূষণ, ধূমপান, মানসিক চাপ বা অলস জীবনযাপন এই অবস্থাকে আরও খারাপ করে। ২০১৮ সালে Frontiers in Medicine এ প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৪০ বছরের বেশি বয়সীদের মধ্যে যারা নিয়মিত গভীর শ্বাসের ব্যায়াম করেন, তাদের ফুসফুসের আয়তন ও অক্সিজেন আদানপ্রদান ক্ষমতা তুলনামূলকভাবে বেশি থাকে।
যোগব্যায়াম কীভাবে ফুসফুসকে শক্তিশালী করে
১. ফুসফুসের ধারণক্ষমতা ও বায়ুপ্রবাহ বাড়ায়
প্রণায়াম বা গভীর শ্বাসের যোগব্যায়াম ফুসফুসকে সম্পূর্ণভাবে প্রসারিত করতে শেখায়। Journal of Clinical and Diagnostic Research (2014) এর এক গবেষণায় দেখা যায়, ৪০ বছরের বেশি বয়সীদের মধ্যে যারা ৬ মাস নিয়মিত যোগব্যায়াম করেছেন, তাদের ফুসফুসের ধারণক্ষমতা ২৫% এবং বায়ুপ্রবাহের হার ৩০% বেড়েছে। অনুলোম বিলোম (alternate nostril breathing) এবং ভ্রমরী প্রণায়াম (humming bee breath) ডায়াফ্রামকে শক্তিশালী করে, শরীরে অক্সিজেন প্রবাহ বাড়ায় এবং কার্বন ডাই অক্সাইড বের করতে সাহায্য করে।
২. শ্বাসপ্রশ্বাসের পেশীকে সক্রিয় করে
ব্রিজ পোজ (Setu Bandhasana), ভুজঙ্গাসন (Cobra Pose) বা উষ্ট্রাসন (Camel Pose) এর মতো বুক খোলার আসন বুকের চারপাশের পেশী ও ফুসফুসকে সক্রিয় করে। Evidence-Based Complementary and Alternative Medicine (2019) এর এক গবেষণায় বলা হয়েছে, নিয়মিত এই আসনগুলো করলে ৪০ থেকে ৬৫ বছর বয়সীদের ফুসফুসের ইলাস্টিসিটি ও বুকের সম্প্রসারণ বৃদ্ধি পায়, ফলে শ্বাস নেওয়া সহজ হয় এবং হাঁপানির মতো উপসর্গ কমে।
৩. মানসিক চাপ কমায়, শ্বাসকে করে ধীর ও গভীর
চাপ ও উদ্বেগের সময় মানুষ সাধারণত ছোট ও দ্রুত শ্বাস নেয়, যা অক্সিজেন প্রবাহ কমায়। যোগব্যায়াম মানসিক প্রশান্তি এনে শ্বাসের ছন্দ ঠিক রাখে। Harvard Health (2020) এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যোগব্যায়াম কর্টিসল হরমোন কমিয়ে স্নায়ুপ্রণালীকে ভারসাম্যপূর্ণ রাখে, ফলে শ্বাস হয় ধীর, গভীর ও স্বাভাবিক। এতে ফুসফুসের পাশাপাশি হৃদযন্ত্রও উপকৃত হয়।
৪. শ্বাসযন্ত্রের রোগে সহায়ক ভূমিকা রাখে
৪০ বছরের পর অনেকেই হাঁপানি বা COPD এর মতো শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা অনুভব করেন। Journal of Thoracic Disease এ প্রকাশিত এক মেটা-অ্যানালাইসিসে দেখা গেছে, ১২ সপ্তাহের যোগব্যায়াম অনুশীলনে COPD রোগীদের FEV₁ (Forced Expiratory Volume) গড়ে ১২৩ মিলিলিটার বেড়েছে এবং হাঁটার সহনশক্তিও বৃদ্ধি পেয়েছে। এটি প্রমাণ করে, যোগব্যায়াম ফুসফুসের মেকানিজম উন্নত করে ও শ্বাসের রিদম নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
৪০ বছরের পর ফুসফুস সুস্থ রাখার জন্য কিছু সহজ যোগব্যায়াম
- ডায়াফ্রামিক ব্রিদিং (পেটের শ্বাস): সোজা বসে বা শুয়ে পেটের উপর হাত রাখুন, গভীর শ্বাস নিন যাতে পেট ফুলে ওঠে, ধীরে ধীরে ছাড়ুন।
- অনুলোম বিলোম: এক নাসা দিয়ে শ্বাস নিয়ে অন্য নাসা দিয়ে ছাড়ুন। শ্বাসপ্রশ্বাসের ভারসাম্য বজায় রাখে।
- ভ্রমরী প্রণায়াম: শ্বাস ছাড়ার সময় গুনগুন আওয়াজ করুন, এতে স্নায়ু শান্ত হয় ও অক্সিজেন প্রবাহ বাড়ে।
- বুক খোলার আসন: Bridge Pose, Cobra Pose, Fish Pose ফুসফুসকে প্রশস্ত করে ও বায়ুপ্রবাহ বাড়ায়।
- দৈনিক ১০ থেকে ১৫ মিনিটের অনুশীলন: নিয়মিত অল্প সময় দিলেও ফুসফুসের কর্মক্ষমতা বাড়ে ও মানসিক প্রশান্তি আসে।
৪০ বছর পেরোলেই যোগব্যায়াম কেবল নমনীয়তার অনুশীলন নয়, এটি ফুসফুসের পুনর্জাগরণের পথ। নিয়মিত অনুশীলনে শ্বাসপ্রশ্বাস গভীর হয়, ক্লান্তি কমে, শরীরে শক্তি ফিরে আসে। প্রতিদিন মাত্র কয়েক মিনিট যোগব্যায়াম আপনাকে মনে করিয়ে দিতে পারে, জীবনের প্রাণশক্তি শুরু হয় একটিমাত্র সহজ শ্বাস থেকে।





